ইসলাম প্রতিষ্ঠাঃ গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থীদের ভাবনায় সৃষ্ট ভ্রান্তি নিরসন–ড. ইয়াদ আল কুনাইবি

 

ইসলাম প্রতিষ্ঠাঃ গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থীদের ভাবনায় সৃষ্ট ভ্রান্তি নিরসন–ড. ইয়াদ আল কুনাইবি



ﺑِﺴْــــــــــــــــﻢِﷲِﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦِﺍلرَّﺣِﻴﻢ ️

█ ১

যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, পার্লামেন্ট কোনো ইসলামী আইন প্রয়োগে সম্মত হলো। তখন সে এই আইনগুলো থেকে ‘আল্লাহর শাসন’ গুণটি বাদ দিয়ে ‘জনগণের শাসন’ গুণটি যোগ করবে। যাতে এটি সংসদীয় ও সাংবিধানিক হয়।

এই বিষয়টিকেই স্পষ্ট করে সংবিধানের তৃতীয় ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, “ক্ষমতা শুধু জনগণের।” চতুর্থ ধারায় আবার বলা হয়েছে: “সমস্ত আইন প্রণয়ন করে প্রয়োগ করা হবে জনগণের নামে।” অর্থাৎ যেহেতু জনগণ এমনটা চায়, সংবিধানও তাই বলে তো কোনোভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব নয়!
সংসদে চেয়ারে বসে অতি তুচ্ছ একজন মানুষ পা নাড়াতে নাড়াতে হাই তুলে মহান আল্লাহর কোনো বিধান বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে ভোট দেবে। আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে ভোট দেবে অতি নগণ্য মানুষ! তারপর এই আইন পছন্দ না হলে ভ্রু কুঞ্চিত করে বিপক্ষে হাত তুলবে। আর যদি পছন্দ হয় পক্ষে হাত তুলবে এমন একটি ভাব নিয়ে যেন সে বলছে, এটি আল্লাহর বিধান নয়, পার্লামেন্টের বিধান।

ওয়াল্লাহি! শরীয়াহকে এইভাবে বিকৃত করা ছাড়া ইসলামপন্থীরা যদি আর কোনো ছাড়ও না দিতেন তাহলেও যথেষ্ট হয়ে যেত।


ওহে পার্লামেন্টপন্থী, জেনে রাখুন, মানবরচিত আইন কিংবা সংবিধানের ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এই নিকৃষ্ট অবস্থান থেকে শরীয়াহকে আরও উঁচুতে তুলুন।



█ ২

যে উদ্দেশ্যে আমরা শাসন ক্ষমতা চাই সে উদ্দেশ্যকেই যদি দরাদরি করতে পাল্লায় তুলি, ক্ষমতায় আরোহন করতে যদি উদ্দেশ্যকেই বিসর্জন দিই তাহলে লাভ আর কী হলো? মাধ্যমের কারণে উদ্দেশ্যকে বিক্রয় করে দেওয়া কি কখনোই গ্রহণযোগ্য?

কল্পনা করুন! আপনি এমন কোন এতিমখানা চিনেন যার পরিচালনা পরিষদ খুব বেশী জালিম। তারা এতিমদের কাপড় দেয়না বরঞ্চ তাদেরকে উলঙ্গ করে রাখে। তো একদিন আপনি এতিমদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এক ব্যাগ কাপড় নিয়ে মুক্তির শ্লোগান দিতে দিতে এতিমখানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। দরজায় আপনাকে বাঁধা দিয়ে জানানো হলো, ভেতরে কাপড় প্রবেশ নিষেধ।

আপনি অনেক দরাদরি করলেন, তাদের সাথে লম্বা আলোচনা করলেন কিন্তু তারা অনড়। আপনি মনে মনে ভাবলেন, অসুবিধে নেই। এতিমদের নাহয় নিজের কাপড় দিয়েই ঢাকবো। তাই শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়ে আপনি কাপড়ের ব্যাগ দরজায় রেখে ভেতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু না আরও একটি দরজা। প্রহরী বললো: ওভারকোট পরিহিত কেউ ভেতরে প্রবেশ করা নিষেধ। এটিও আপনি মেনে নিলেন। কাপড়টি রেখে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন আরেকটি দরজা। একের পর এক দরজা। এভাবে শর্ত পূরণ করতে করতে সবগুলো দরজা পাড়ি দিয়ে একসময় আপনি আবিস্কার করলেন যে, লজ্জাস্থান ঢাকার মত কাপড়টিই এখন শুধু বাকী।

আপনি ভাবলেন: এখনও তো তাদেরকে দেওয়ার মত কিছু বাকী আছে। তারা যখন আমাকে লজ্জাস্থান ঢাকা অবস্থায় দেখতে পাবে, তখন নিশ্চয় তাদেরও নিজেদের অঙ্গ ঢাকার ইচ্ছে জাগবে। আমার সাথে মিলে তারা এই জালিম ও ইতর প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে।

লক্ষ্য করুন, যে ব্যক্তি মুক্তির শ্লোগান দিতে দিতে এতিমখানায় এসেছিল তার প্রত্যাশা কোথায় এসে ঠেকেছে। যদি ছাড় দেওয়ার পরিণামে তার প্রাপ্য অংশ কতটুকু এই ব্যাপারে প্রথম থেকেই সে জানতো, তবে কখনো কি এই পথে পা বাড়াতো?নিশ্চয় না।

তার এই কাজ আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতার শামিল।
وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ
শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা।
শয়তান তো সে,
یَعِدُہُمۡ وَ یُمَنِّیۡہِمۡ ؕ وَ مَا یَعِدُہُمُ الشَّیۡطٰنُ اِلَّا غُرُوۡرًا
যে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদেরকে আশ্বাস দেয়। শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা সব প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।



█ ৩

“রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।” এটি তো স্পষ্ট বিষয় যে, এই বাক্যটি সংবিধান প্রণেতাদের নিকট কোনো অর্থই রাখে না; বরং বলতে গেলে এটি একটি সুন্দর ডেকোরেশন। যার সাহায্যে খুব সহজে মানুষদের বোকা বানিয়ে তাদের উপহাস করা যায়।

এই কথাটি বুঝতে পারবেন যদি একটি বিষয় লক্ষ করেন; কেউ মুসলিম দেশে আল্লাহকে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে গালি দিল, তার বিধান নিয়ে মজা উড়াল, কিন্তু লোকটির জাতীয় আইডিকার্ডে লেখা রয়েছে ‘ধর্ম: ইসলাম’। এখন আপনি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে কখনোই বিজয়ী হবেন? আপনি নিজেই জানেন যে, বিজয়ী হওয়া অসম্ভব।

এভাবে সে লোকটির বাবা মারা যাওয়ার পর আপনি যদি মামলা দায়ের করে বলেন যে, তার বাবা মুসলিম ছিল কিন্তু সে কাফের। আর একজন কাফের মুসলিমের উত্তরাধিকার সম্পত্তি পায় না। আদালত কি আপনার এই যুক্তি মেনে নেবে?

যদি সে লোকটি কোনো মুসলিম মহিলাকে বিয়ে করে রাষ্ট্র কি এই বিয়েতে বাধা দেবে? কেন দেবে না? কারণ, সরকারিভাবে এই লোকটির ধর্ম ইসলাম; বরং আপনি যদি তার বিরুদ্ধে কুফরী ও রিদ্দার মামলা করেন, আর এ-কারণে সে যদি আপনার বিরুদ্ধে হয়রানির মামলা ঠুকে দেয়, তাহলে স্পষ্ট কথা এই মামলায় সে-ই বিজয়ী হবে।

যে রাষ্ট্র এই মুরতাদ ব্যক্তির ধর্মীয় পরিচয় ইসলাম বলে জিদ ধরে আছে, ঠিক সে রাষ্ট্র নিজের ধর্মীয় পরিচয় ইসলাম লিখে রেখেছে। ‘ধর্ম’ শব্দটি যেভাবে এই ব্যক্তির পরিচয় বহন করছে ঠিক একইভাবে সংবিধানের ক্ষেত্রেও একই পরিচয় বহন করছে। বোঝা গেল, রাষ্ট্রের নিকট এই উদ্ধৃতির কোনো গুরুত্বই নেই।

█ ৪

এই জাহেলী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদাহরণ অনেকটা ভাঙনের প্রান্তে অবস্থিত পতনোন্মুখ দালানের মতো। আমরা যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত তাদের কর্তব্য হলো জনগণকে সতর্ক করে বলা: এই দালান অচিরেই ধ্বংস হবে, তার আগেই আপনারা এখান থেকে সরে পড়ুন।

কিন্তু নিজেরাই সে দালানে প্রবেশ করে ছোটখাটো সংস্কারকাজ চালিয়ে সেখানকার ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা নিঃসন্দেহে ধোঁকা। কারণ, যে দালান দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, অচিরেই যার পতন ঘটবে এমন দালান সংস্কারের তো কোনো অর্থ দাঁড়ায়না। ভঙ্গুর যে রাষ্ট্রব্যবস্থা মেরামতের আমরা কসরত চালিয়ে যাচ্ছি অচিরেই তা আমাদেরসহ নিয়ে ইতিহাসের অন্ধকার গর্তে হারিয়ে যাবে। তখন জনগণের সামনে দেখানোর মতো মুখ আর বাকি থাকবে না।


“ইসলাম প্রতিষ্ঠাঃ সমকালীন ভাবনায় সৃষ্ট ভ্রান্তি নিরসন, ড. ইয়াদ কুনাইবী হাফিজাহুল্লাহ” বই থেকে।

0 মন্তব্যসমূহ