এই শতাব্দী সেক্যুলারিজমের পতনের শতাব্দী।

 এই শতাব্দী সেক্যুলারিজমের পতনের শতাব্দী।



🔶প্রথম অংশঃ

মধ্যযুগে ইউরোপের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গির্জার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হত। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পোপতান্ত্রিক আধিপত্য ছিলো পুরো দমে। পুরো ইউরোপ মহাদেশ কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। প্রতিটি রাজ্য আলাদা সম্রাটরা পরিচালনা করলেও তাদেরকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করত গির্জার অধিপতিরা। পোপ তথা ধর্ম গুরুদের আশীর্বাদ ছাড়া কোন সম্রাটই নিজের রাজ্য স্বাচ্ছন্দের সাথে শাসন করতে পারেনি কখনো। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে সম্রাটরাও গির্জার ছায়াতেই নিজেদের আশ্রয় খুঁজতো এবং পোপদের নিয়ন্ত্রণকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত না।


যদিও এর বিপরীত ইতিহাসও রয়েছে। অর্থাৎ অনেকেই চেয়েছিলো তাদের রাজ্য পরিচালনায় গির্জা তথা ধর্মের কোন আধিপত্য না থাকুক। পোপ তথা ধর্মগুরুরা রাজ্য পরিচালনায় নাক না গলাক। কিন্তু যখনই তারা গির্জার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিলো বা তাদেরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছিলো, তখনই তারা উৎখাত হয়েছিলো। নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি। হয়তো জনগণই তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে নয়তো রাষ্ট্রীয় কোনো উচ্চ পদধারী ব্যক্তি গির্জার সমর্থনে বিদ্রোহ করে তাকে উৎখাত করে সে স্থান নিজে দখল করেছে। এক কথায় রাষ্ট্র পরিচালনায় গির্জার প্রভাব ছিলো অপ্রতিরোধ্য, অতুলনীয়। 


গির্জাধিপতিরা তাদের এই  অপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে হজম করতে পারেনি। তারা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলো সর্বাত্মকভাবে। ধর্মকে বিকৃত করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার যতগুলো মাধ্যম, সবগুলো তারা ব্যবহার করেছিলো। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতে যখন যা খুশি তাই করতো। তাদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার অধিকার কারো ছিলো না। যেখানে সম্রাটরাই গির্জার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারত না, সেখানে সাধারণ জনগণের কথা বলতে সাহস করার প্রশ্নই ওঠেনা!


কয়েক শতক ধরে এমন অবস্থা চলমান থাকার ফলে গির্জার বিরুদ্ধে (আসলে ধর্মের বিরুদ্ধে) তাত্ত্বিকভাবে কিছু ব্যক্তি-দার্শনিক দাঁড়িয়ে যায়। পোতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী দর্শন ও সিস্টেম ক্রিয়েট করতে সক্ষম হয় তারা। সেটার পক্ষে তারা শক্তিশালী সাহিত্যও রচনা করে ফেলে! সবকিছু অতি সংগোপনেই হচ্ছিল। তবে এর পাশাপাশি তারা ভেতরে ভেতরে একটি পক্ষকে গির্জার বিরুদ্ধে বোঝাতেও সক্ষম হয়। গির্জার অপশাসন ও দুর্নীতির ফলে তারাও সে দর্শন বা সিস্টেমকে সহজেই গিলে ফেলে। এবং আস্তে আস্তে সেই দর্শন বা সিস্টেম ইউরোপ কে ছাপিয়ে পুরো বিশ্বকেই এখন গ্রাস করে নিয়েছে।


সেই দর্শন বা সিস্টেমের পোশাকি নাম হলো secularism. মধ্যযুগের 'ইউরোপীয় রেনেসাঁস'(১৪০০-১৬০০) ইউরোপের ইতিহাসে তো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসেও এক বিরাট ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে পরিগণিত হয়। এই ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অন্যতম একটি উপাদান ছিলো এই Secularism তথা ধর্মনিরপেক্ষতা। এই দর্শনের মূল কথা হলো, 


"রাষ্ট্র আর ধর্ম আলাদা। রাষ্ট্রে ধর্মের কোন কর্তৃত্ব চলবে না। ধর্ম ধর্মের জায়গায়, রাষ্ট্র রাষ্ট্রের জায়গায়। রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। ধর্ম চলবে ধর্মের গতিতে। রাষ্ট্র চলবে রাষ্ট্রের গতিতে।" 


গির্জা তথা পোপদের চরম ব্যর্থতার ফলে ইউরোপে খুব দ্রুতই এই সেক্যুলারিজম ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্বল্প সংখ্যক সম্রাট ব্যতীত অধিকাংশ সম্রাটই এই সেক্যুলারিজমকে জনপ্রিয় করে তুলতে সাহায্য করে। কারণ, এতে করে তাদের স্বার্থই সবচেয়ে বেশি হাসিল হওয়ার ছিলো। পোপদের একনিষ্ঠ অনুসারীরা ছাড়া অন্য সবাই সেক্যুলারিজমের দিকে জোয়ারের মতো ঝুঁকে পড়ে। অবসান ঘটে গির্জার কর্তৃত্বের। সেই সাথে প্রকৃতপক্ষে ধর্মের কর্তত্বের অবসান ঘটে! জয় লাভ করে এক নতুন ধর্ম 'সেক্যুলারিজম'!


বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে খিলাফাহর পতন ঘটার সাথে সাথে এই সেক্যুলারিজম খুব দ্রুতই পুরো বিশ্বকে নিজের করায়ত্তে নিয়ে নেয়। ধর্মের শাসন বলতে যা ছিলো, ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে 'ওসমানী সালতানাতের' পতন ঘটার সাথে সাথে তা-ও পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায়! পুরো বিশ্বে তখন সেক্যুলারিজম নির্ভীঘ্ন এবং বাঁধাহীনভাবে এগোতে থাকে। বিগত ১০০ বছরে বিশ্বে  এমনভাবে সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, যেন সে অপ্রতিরোধ্য! তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো কোনো শক্তি নেই! পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু,, বিশ্বের প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি জায়গায় সেক্যুলারিজমের জয়জয়কার! 


সেক্যুলারিজমের ধারণা বা দর্শন সৃষ্টির পেছনে কোন একক ব্যক্তির কৃতিত্ব নেই। এটি ধীরে ধীরে ইতিহাসের নানা দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রভাবের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। তবে আধুনিক সেকুলারিজমের অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে ইংরেজ দার্শনিক Thomas Hobbes থমাস হোপস এবং ফরাসি দার্শনিক Voltaire ভলতেয়ার কে ধরা হয়। তারা সেক্যুলারিজমের পক্ষে অনেক তাত্ত্বিক কথা লিখেছে। যা সেক্যুলারিজমের পক্ষের লজিক শক্তিশালী করেছে। এছাড়াও Jhon Locke, জন লক, Jhon Rowlse জন রলস, এবং Baron de Montesquieu বারন ডি মন্টেস্কি-দের অবদান রয়েছে এর ধারণার উন্নতিতে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এর প্রভাব বিস্তারে। 


🔶দ্বিতীয় অংশ 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ডারত পাকিস্তান আলাদা(১৯৪৭) হলো। অতঃপর নানান ঘটনা প্রবাহ পেরিয়ে পাকিস্তানও দু'টি ভাগে ভাগ হলো। ভাগ হবার পরে বাংলাদেশ নামক নতুন যে রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় হলো, সেই রাষ্ট্রের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রথম এবং অন্যতম একটি নীতি হলো এই 'সেক্যুলারিজম' তথা ধর্মহীনতা। এ দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও রাষ্ট্র পরিচালিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ নীতি দ্বারা। 

শিক্ষানীতি, সমাজনীতিসহ প্রতিটি নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ধর্মহীনতাই থাকে প্রধান ভিত্তি। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই সেক্যুলারদেরই প্রভাব সর্বত্র। তাদের নীতি প্রণয়ন ও আদেশ নিষেধই শেষ কথা। তাদের হাতেই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ। এর ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেক্যুলারদের একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। সেক্যুলারিজম বিরোধী কিছু হলেই অমনি সবাই একসাথে তার বিরুদ্ধে হামলে পড়ে! সরব হয়! আমরা সব সময় শত বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে এই পয়েন্টে সবাইকে একতাবদ্ধ দেখতে পেয়েছি। 


কিন্তু মজার বিষয় কী জানেন? পুরো বিশ্বব্যাপী সেক্যুলারিজমের অসারতা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেকুলারিজমের অপ্রয়োজনীয়তা,অনিষ্টতা সম্পর্কে সবাই সচেতন হতে শুরু করেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ,এম্রিকা, ডারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে অতি ডান পন্থা রাজনীতির সরব উত্থান এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে যেগুলো অতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে, সেই রাষ্ট্রগুলোতেও তাত্ত্বিকভাবেই  সেক্যুলারিজম বিরোধী একটি বড় গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গিয়েছে সচেতন ভাবে। এই গোষ্ঠি বা মহল কিন্তু সমাজের অপাঙ্ক্তেয় বা নিম্নশ্রেণির অংশ নয়। নয় তাঁরা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা মূর্খ-বোকাসোখা! তারা শহুরে উচ্চ শ্রেণী শিক্ষিত মহল এবং ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন। এমনকি সেক্যুলারিস্ট তৈরির কারখানা থেকেই সেক্যুলার বিরোধীরা গড়ে উঠছে!


এদেশে কিছুদিন আগেও শরিয়াহ, খিলাফাহ নিয়ে কথা বলা যেত না। ধর্ম বলতে কেবল নামাজ রোজা, মসজিদ মাদ্রাসাকেই বুঝতে সবাই। এর বাইরে যে কোনো কিছুতে ধর্মকে টানা ছিলো বিরাট অপরাধ। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এখন সবাই সবকিছুতেই ধর্মের অপরিহার্যতা স্বীকার তো করছেই, বরং শরিয়াহ বাস্তবায়নের কথাও এখন উচ্চস্বরে বলছে। মসজিদ মাদরাসা থেকে তো নিশ্চয়ই,,কলেজ-ইউনিভার্টি থেকেও এখন সেক্যুলার বুলি-স্লোগানের পরিবর্তে শরিয়াহ, খিলাফাহ, কালেমা, তাওহীদ ও আক্বিদার আওয়াজ শোনা যায়! তাদের হাতে সেক্যুলার-কমিউনিস্ট সাইন সিম্বল সম্বলিত ব্যানার ফেস্টুনের পরিবর্তে কালেমা খচিত ব্যানার ফেস্টুন এবং প্লাকার্ড শোভা পায়। কপালে এবং বুকে বাঁধা থাকে কালেমার পতাকা।


ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, সেক্যুলার শিবির যখন এগুলো নিয়ে হাউমাউ শুরু করে, তখন এটাকে সেক্যুলার বিরোধীরা নিজেদের জন্য উৎসাহ হিসেবে বিবেচনা করে নিজেদের কাজগুলোকে আরও বৃদ্ধি করে। সেকুলার গোষ্ঠী যেগুলোতে বেশি জ্বলে ওঠে, সবাই সেই কাজগুলোই আরো বেশি বেশি করে আঞ্জাম দেয়। ভয় না পেয়ে বরং নিজেদের কাজের গতি বৃদ্ধি করে। অতি সম্প্রতি যশোরের একটি মাদ্রাসায় 'যেমন খুশি তেমন সাজো' একটি অনুষ্ঠানে হা'মা'সের বেশ ধরে শিশুরা যে প্রদর্শনী অনুষ্ঠান করলো, সে অনুষ্ঠান নিয়ে শাহডগিদের প্যান্ট গরম হওয়ার যে বিষয়টা, সেটাকে একদমই পাত্তা না দিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি গত পরশু এবং গতকালকেও একটি স্কুল ও মাদরাসার অনুষ্ঠানেও হামা'সের বেশ ধারণ করে প্রদর্শনী অনুষ্ঠান করতে।


শাহডগিদের উদ্বেগ উত্তেজনাকে ভয় না পেয়ে বরং তাদের উদ্বেগ ও বিরোধীতাকে সবাই হেসে খেলে, ট্রল করে একদম ফু দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। বাচ্চারা নিজেদেরকে আবু উবায়দার বেশে দেখতে পছন্দ করছে! মু'জা'হিদদের বেশ ধারণ করে সেটাতে তৃপ্তি পাচ্ছে। নিজেদেরকে তাদের রূপে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এক্ষেত্রে তাদের কথা ও মন্তব্যকে নিছক পাগলের প্রলাপ বিবেচনা করে সেগুলোকে ফেলে দিচ্ছে। যেন তারা কোনো ভিনগ্রহ থেকে ভুলক্রমে এখানে চলে এসেছে। তাদের কথার কোনো মূল্যই নেই! এই প্রবণতা কিসের ফল? 


এই শতাব্দি সেক্যুলারিজমের পতনের শতাব্দী। এই শতাব্দীতেই সেক্যুলারিজমের দাফন সম্পন্ন হবে ইন শা আল্লাহ। বিশ্বব্যাপী খিলাফাহ-শরীয়াহ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সেক্যুলারিজমের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকা হবে ইন শা আল্লাহ। 


✍️মুয়াজ বিন মুরাদ

0 মন্তব্যসমূহ